এরপর আমি আর জান্নাত একসাথে অনেকক্ষন হাঁটাহাঁটি করলাম।জান্নাত আমার হাতটা নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটছিলো।কারন ওর মনে হচ্ছিলো আমার মা ওকে কখনোই মেনে নিবে না।আমরা এরপর বাসায় চলে আসি।আমাদের দুজনেরই মন ভীষণ খারাপ।আমরা দুজনক অনেক ভয়ে আর চিন্তায় আছি।আমি সন্ধ্যায় মাকে ফোন দিলাম।মা ফোন রিসিভ করলে আমি বলি…..
আমিঃমা…
মাঃহ্যাঁ বাবা বল।
আমিঃমা তুমি রাতে ঢাকার জন্য রওনা দিতে পারবে?তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিলো।
মাঃকিহ!কিছু হয়েছে তোর বাবা?তুই ঠিক আছিস?বাইক এক্সিডেন্ট করেছিস নাকি!(খুব উত্তেজিত হয়ে)
আমিঃআরে না না।আমি একদম ঠিক আছি।তুমি ঢাকা আসলে সব বুঝতে পারবে।
মাঃআমি তোর মামাকে বলে এখনি রওনা হচ্ছি দাঁড়া।
আমিঃঠিক আছে।তুমি কোনো চিন্তা করো না।আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।তুমি সাবধানে আসো।
মাঃঠিক আছে।
এরপর ফোন রেখে দিলাম।মা সকাল নাগাদ ইনশাআল্লাহ চলে আসবে।জান্নাতকে কথাটা জানালাম।ও উঠে সম্পূর্ণ ঘর সুন্দর করে পরিষ্কার করতে শুরু করলো।আমি ওকে বললাম এসবের দরকার নেই।কিন্তু জান্নাত শুনলোই না।ও পুরো ঘর গুছিয়ে পরিষ্কার করে মুছে চকচক করলো।আমি বুঝলাম জান্নাত আমাকে কতোটা চায়।আমি ওর কাছে গিয়ে ওকে বসিয়ে ওর মুখের ঘাম মুছে দিতে দিতে বললাম…..
আমিঃইনশাআল্লাহ মা আমাদের মেনে নিবে।আমরা তো খারাপ কিছু চাচ্ছি না।এরপরও যদি সে না মানে তাহলে বুঝতে হবে আমাদের কপালে এক হওয়া নেই।
জান্নাতঃআপনাকে পাওয়ার জন্য আমি সব করতে রাজি আছি।আপনি শুধু আমাকে হুকুম করবেন।
আমি মুচকি হেসে জান্নাতের মাথাটা আমার কাঁধে রেখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।আমার নিজেরও খুব ভয় আর চিন্তা হচ্ছিলো।রাতটা আমরা দুজন নির্ঘুম পাড় করলাম।পরদিন সকাল সাতটা নাগাদ মা বাসায় আসলো।আমি জান্নাতকে আমার রুমে লুকিয়ে রেখেছি।মা রীতিমতো অস্থির হয়ে এসেছে।বাসায় ঢুকেই আমার মাথা শরীর হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে…..
মাঃবাবা তুই ঠিক আছিস?কি হয়েছে তোর?এই যে আমি আসছি।বল আমাকে কি হয়েছে।
আমিঃমা শান্ত হও।সব বলবো।আগে তুমি ফ্রেশ হও একটু রেস্ট নেও।অনেক দূর থেকে এসেছো।
মাঃআচ্ছা ঠিক আছে।
মাকে তার রুমে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আমার রুমে আসলাম।জান্নাত এক কোনায় অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে।ওর কাছে গিয়ে দেখি বোকাটা কাঁদছে।আমি ওর চোখ মুছে দিয়ে বললাম…..
আমিঃকান্না করছো কেন তুমি?আল্লাহ ভরসা।
জান্নাতঃআন্টি যদি রাজি না হয়,আমাকে যদি বের করে দেয়।আমি তো আর কখনো আপনাকে পাবো না৷
মাঃআমারও কষ্ট হচ্ছে।গলা একদম শুকিয়ে আসছে চিন্তায়।মা আমাকে অনেক ভালবাসে।আমি তার পা ধরে বসে থাকবো তুমিও আমার পাশে থেকো।দেখি মা মানে কিনা৷
জান্নাতঃঠিক আছে আপনি যা বলবেন তাই।
এরপর মা ফ্রেশ হয়ে এসে হল রুমে বসে।সে বসতেই আশেপাশে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে…..
মাঃকিরে রাশেদ বাসাটা এমন চকচক করছে কেন?কে পরিষ্কার করেছে?
আমি আস্তে আস্তে মায়ের সামনে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ি।মা ভীষণ অবাক হয়ে বলে…..
মাঃকি হয়েছে?আমার পা ধরছিস কেন?
আমিঃমা আমি তোমার কাছে আজকে একটা জিনিস চাইবো।তুমি প্লিজ না করবানা।
মাঃআমার কাছে কি চাবি?এই বাড়িঘর টাকা পয়সা সবই তো তোর।আমি আর কি দিবো তোকে?
আমিঃজান্নাত…..
আমি জান্নাতকে ডাক দিলাম।জান্নাত আমার রুম থেকে বের হয়ে এসে আমার পাশে এসে বসলো।মা পুরো সকড।সে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।আমি মাকে বললাম…..
আমিঃমা আমি ওকে চাই তোমার কাছে।
মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্থীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে…..
মাঃ তুই কি ওকে বিয়ে করেছিস?
আমিঃনা না মা।কি বলো তুমি!তোমার অনুমতি ছাড়া আমি এতো বড় একটা কাজ কিভাবে করবো!তবে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।তোমার অনুমতি চাই বলেই তোমাকে গ্রাম থেকে ঢাকা আসতে বলেছি।
মাঃতুই ওকে কোথায় পেলি?আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা৷তোকে আমি সবসময় জিজ্ঞেস করে এসেছি তোর কোনো পছন্দের মেয়ে আছে কিনা।তুই বলেছিস নাই,তাহলে ও কোথা থাকে আসলো রাশেদ?উত্তর দে।(মা রেগে গিয়েছে)
আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি।তাও আল্লাহর নাম নিয়ে আমি মায়ের পা জড়িয়ে ধরেই জান্নাতের সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যা যা হয়েছে সবকিছু খুলে বললাম। সব শেষে বললাম…..
আমিঃমা ও খুব ভালো একটা মেয়ে।দেখো কতো সুন্দর করে তোমার ঘর গুছিয়েছে তুমি আসবে বলে।তোমার মতো রান্নাও পারে।সেই ওকে কিভাবে আমি জেনে শুনে ওদের কাছে পাঠিয়ে দি বলো?আর সবচেয়ে বড় কথা আমার ওকে ভালো লেগেছে।তাই মা আমি চাই তুমি আমাদের বিয়ে দিয়ে দেও।তুমি আজ আমাদের অনুমতি দিলে ওর জীবনটা বেঁচে যাবে আর আমি আমার মনের মতো কাউকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পাবো।এখন তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে আমরা দুজন তা মাথা পেতে নিবো।তুমি যদি না করে দেও আমি ওকে এখনই পাঠিয়ে দিবো৷তোমার দোয়া আর অনুমতি ছাড়া আমরা কিছুই করবো না।
মা আমাদের দুজনের দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইলেন।জান্নাত মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদছিলো।মেয়েটা খুব অসহায় হয়ে পড়েছে।মা ওর হাত ধরে উপরে তার পাশে বসায়।জান্নাতের মুখখানা তুলে সে ভালো করে দেখছে।দুহাত দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে মা বলে…..
মাঃএতো মিষ্টি মেয়ের মুখে কান্না মানায় না৷
আমি সাথে সাথে খুশিতে মায়ের দিকে তাকাই।জান্নাতও অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আরও জোরে কান্না করে দেয়।মা ওকে তার বুকে নিয়ে বলে…..
মাঃআমি খুব কষ্ট পেতাম যদি তোরা আমাকে কিছুই না জানিয়ে বিয়েটা করে ফেলতি।তোরা যে আমাকে মা হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছিস,আমার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করেছিস আমি এতেই খুশি।আর ওকে আমার প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়েছে।কি মিষ্টি মায়াবী মুখ।আহরে!মা তুমি আর কান্না করো না৷তোমার আপন মা তোমাকে ছেড়ে গেলেও আজ তুমি আরেকটা নতুন মা পেলে।আমার ছেলেটা অনেক ভালো।তোমার কোনো কষ্ট হবেনা।জান্নাত মাকে জড়িয়ে ধরে বলে…..
জান্নাতঃমা আপনি বললে আমি আপনাদের জন্য আমার জীবনটাও দিয়ে দিবো।তাও আমাকে আপনাদের ছায়াতল থেকে সরিয়ে দিবেন না কখনো।
মাঃধুর বোকা মেয়ে এগুলো বলেনা।আমি চাই তোমরা দুজন সারাজীবন সুখী হয়ে থাকো।আমি রাশেদকে সেই কবে থাকে বিয়ে করতে বলছি কিন্তু ও করছেই না।আমি এবার রাগ করেই চলে গিয়েছিলাম৷যাক আমার ছেলেটা যে শেষমেশ কাউকে পছন্দ করেছে বিয়ে করতে চাচ্ছে আমি এতেই খুশি।একটা মা কি চায় জানো,তার ছেলে মেয়েরা এমন কাউকে বিয়ে করুক যাকে সে মন থেকে পছন্দ করে।যাতে তারা সারাজীবন সুখী থাকে।আমিও তাই চেয়েছি।আজ ওর বাবা থাকলে সেও অনেক খুশি হতেন।আমি নিজ হাতে তোমাদের বিয়ে দিবো।রাশেদ তোর মামা খালাদের ফোন দে।তাদের সবাইকে আসতে বল।যতো তাড়াতাড়ি পারি আমি তোদের বিয়েটা দিবো।তোকে বিয়ে দেওয়াটা আমার অনেক বড় একটা দায়িত্ব ছিলো।আজ সে দায়িত্ব থেকে আমি মুক্ত।এখন যদি আমি তোর বাবার কাছেও চলে যাই আমার আর কোনো আফসোস থাকবে না।তবে নাতির মুখখানা দেখে গেলে মন্দ হয় না।হাহা।
মায়ের কথা শুনে আমরা দুজন কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দিলাম।মা আমাদের দুজনকে তার দুপাশে নিয়ে দোয়া করে দিলেন।সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছিলো কিন্তু এটাই বাস্তব।বাবা-মা আমাদের ভালো চান৷তারা আমাদের কাছে কখনোই কোনো কিছু আশা করেন না।তারা শুধু আমাদের ভালো দেখতে চান।জান্নাত আর আমি আজ অনেক খুশি।আমাদের আলাদা হতে হবে না।আমরা আমাদের ভালবাসা নিয়েই সারাজীবন একসাথে থাকতে পারবো।এরপর মায়ের পরিবারের সবাই ঢাকা আসলো।তারাও সবাই জান্নাতকে খুশি মনে মেনে নিলো এবং খুব বড় আর ধুমধাম করে আমাদের দুজনের বিয়ে হলো।আমরা যদি সমাজের ভয়ে চুপ হয়ে যেতাম তাহলে হয়তো আজ আমরা এক হতে পারতাম না।জান্নাতকে আমার জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে আমি ধন্য।জান্নাত আমার বুকে মাথা রেখে বলছে…..
জান্নাতঃরাশেদ সাহেব,আপনি আজ আমার জীবনটা ভরে দিলেন সীমাহীন আনন্দ আর ভালবাসা দিয়ে।আমি কল্পনাও করিনি আপনাকে আমি আমার করে পাবো।আমি সারাজীবন আপনার দাসী হয়ে থাকবো।কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেন না প্লিজ।
আমিঃছিঃ ছিঃ দাসী কেন বলছো।তুমি আমার ভালবাসার বউ।আমার রাণী হয়ে থাকবে তুমি।তুমি আমার সম্পূর্ণ পৃথিবীটা জুড়ে থাকবে তুমি।
এরপর জান্নাতকে একদম আমার নিজের করে আলিঙ্গন করে নিলাম।ভরিয়ে দিলাম ওকে ভালবাসার স্পর্শে।আমাদের অপেক্ষার ফল আজ মিষ্টি হলো।আর সেই সাথে নতুন এক জীবনের গল্প শুরু হলো…!!
সমাপ্ত…..