দেখলাম জান্নাতের চোখজোড়া অশ্রুতে ভরে এসেছে।সে আড়ালে মুছে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলো…..
জান্নাতঃআমি কাউকে ভালবেসে ঢাকাতে আসিনি কিংবা আমার এখানে পরিচিত কেউই নেই।আপনাকে রাতে যা বলেছি সবই মিথ্যা ছিলো।শুধুমাত্র আপনি যেনো আমাকে একটু জায়গা দিন তাই মিথ্যাগুলো বলেছি।
জান্নাতের কথা শুনে আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম।এই মেয়ে বললোটা কি!তার কোনো প্রেমিক নেই!সে আমাকে মিথ্যা বলেছে!তাহলে সত্যটা কি?আমি অবাক কণ্ঠে জান্নাতকে জিজ্ঞেস করলাম…..
আমিঃআপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন!কেন?আর সত্যটা তাহলে কি?আমাকে সব খুলে বলুন।
জান্নাত অঝোরে কান্না করতে করতে বললো…..
জান্নাতঃআমার আপন মা মারা গিয়েছে আমার বয়স যখন পনেরো বছর।মা মারা যাওয়ার ঠিক তিনমাস পরই বাবা আরেকটা বিয়ে করে।আমি তখন ছোট হলেও সব বুঝি।খুব অবাক হই সেদিন,যে কিভাবে বাবা মা মারা যাওয়ার মাত্র তিনমাসের মাথায় আরেকজনকে বিয়ে করে বাসায় আনে।আমার মায়ের গর্ভে শুধু আমি একাই ছিলাম।মাকে হারিয়ে আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে যাই।আমার সাজানো সুন্দর জীবনটা হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে যায়।কিন্তু যখন নতুন মা আসে বাবার উপর কিছুটা রাগ হলেও নতুন মায়ের ভালবাসা দেখে আমি আস্তে আস্তে ঠিক হচ্ছিলাম।কিন্তু যেই বিয়ের ছয়মাস পার হয় আপন মা আর সৎ মায়ের তফাৎটা আমি হারে হারে বুঝতে শুরু করি।আমার সৎ মা আর আমাকে কাছে ডাকে না,আমাকে খেতে বলে না,আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে না।আমি যদি নাও খেয়ে থাকি একটাবার এসে কোনো খবরও নেয় না।একদিন খুব অসুস্থ হয়ে সারাদিন বিছানায় পড়েছিলাম।না বাবা না আমার সৎ মা আমাকে দেখতে এসেছিলো।ভাগ্য ভালো সেদিন কোথা থেকে যেনো ছোট মামা আমার প্রিয় ফল মানে লিচু নিয়ে আসছিলো আমার কাছে।এসে দেখে আমার এই অবস্থা।সেদিন মামা যদি আমাকে হাসপাতালে না নিতো তাহলে হয়তো আপনার আজ এতোটা সমস্যা হতো না।শুধু আপনার না আমার পরিবারও আমার বোঝা থেকে বেঁচে যেতো।হাহা।যাইহোক,সেদিন থেকে শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই।আমি বুঝে যাই,যে আমার আপন মায়ের সাথে আমার আপন বাবাও চলে গিয়েছে।কারন সৎ মা আমাকে সরাতে চাচ্ছিলো।সেটা বাবা বুঝেও সৎ মাকে কিছু না বলে সেও উঠে পড়ে লাগে আমাকে ভাগানোর জন্য।মামাবাড়ি,নানাবাড়ি পালিয়ে পালিয়ে কোনোরকম ইন্টারটা আমি পাশ করি।আমার পড়াশোনার যাবতীয় খরচ আমার মামারাই দিতো।কারন আমার সৎ মা আমাকে বের করতে সক্ষম হয়েছে বাসা থেকে।বের করবেই বা না কেন,তার অনাগত সন্তান যেনো বাবার সব সয়-সম্পত্তি পায় সে জন্যই আমাকে সরানো।আমি পালিয়ে পালিয়ে পাঁচটা বছর পার করি।কিন্তু এখন আর পারছিলাম না৷বাবা আমাকে বাসায় বন্দি করে ফেলে যাতে সে আর সৎ মা মিলে তাদের ঠিক করা এলাকার সবচেয়ে বড় গুন্ডাটার কাছে আমাকে বিক্রি করতে পারে।বিয়ের সবকিছু ঠিক হয়ে গিয়েছিলো।আমি তখনও ঘরে বন্দি,কিছুই জানিনা।আমাদের বাসায় সেই প্রথম থেকে কাজ করা একটা খালা ছিলো যে মায়ের সাথে থাকতো সবসময়।সে সবকিছু বুঝে তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে।রাশেদ সাহেব সে আর কি করেছে জানেন?তার জমানো ৩ হাজার টাকা আমাকে দিয়ে বলেছে “মা তুই এখান থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যা।আর কোনোদিন আসিস না।তুই যা মা”।আমি রাত এগারোটার ট্রেনে উঠে সকালে ঢাকায় এসে পৌঁছাই।আমি জানতাম ঢাকাতে হাতিরঝিল নামে সুন্দর একটা জায়গা আছে তাই এখানে এসে অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে বসে থাকি।আমি কোনো ফোন আনিনি নাহলে ওরা আমাকে খুঁজে বের করে ফেলবে।রাত যতো গভীর হতে থাকে আমি দিশাহীন হতে থাকি।খুব ভয় করছিলো।কারন অনেকেই আমার দিকে কেমন কেমন ভাবে জানি তাকাচ্ছিলো।আমার খুব ভয় করছিলো তাও সাহস করে কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য অনেকবার ইশারা করি।কিন্তু কেউ গাড়ি থামায়নি।তাই আপনার বাইকের সামনেই চলে আসি আমি।আপনাকে দেখে কেমন জানি স্বস্তি পাই।তাই আমার এতো বড় গল্প না বলে একটা মিথ্যা গল্প বানিয়ে বলি যাতে আপনি আমাকে একটু সাহায্য করেন।কিন্তু আমি মোটেও ভাবিনি আপনি আমাকে সন্দেহ করবেন বা খারাপ ভাববেন।আমি হতাশ হয়ে যাই যখন আপনি চলে যান৷ঠিক করি এই পানিতে ঝাপ দিয়েই মায়ের কাছে চলে যাবো।ঠিক তখনই আপনি আবার আসেন আর তারপর তো সব আপনার জানাই।একটা গুন্ডার কাছে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ হওয়া থেকে বাঁচতেই এই অজানা ইটপাথরের শহরে চলে এসেছি।জানিনা সামনে কি আছে আমার কপালে।আপনি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করবেন।আসলে আমি চাইলে হয়তো আরও অনেকদিন আপনাকে এই মিথ্যা বলে থাকতে পারতাম কিন্তু আমার মনটা ভারী হয়ে আসছিলো।আপনি খুব ভালো একটা মানুষ তাই আজ সত্যিটা বলেই দিলাম।আমাকে ক্ষমা করবেন।আপনার যদি আমার এই সত্য শুনে আমাকে খারাপ মনে হয় আপনি বলুন আমি এখনই চলে যাবো।
কথাগুলো শেষ করে জান্নাত ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।আমি সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে।আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।দুনিয়ায় এমন বাবা-মাও হতে পারে!তাহলে কি এই চাপা কষ্টের জন্যই জান্নাত এভাবে কেঁদে কেঁদে উঠছিলো?
জান্নাতের এই অপ্রিয় সত্য শুনে আমার মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে।আমি জানতাম বাবা-মার মতো আপন আর কেউ হয়না।সেই বাবা-মাই যে সন্তানের কাল হয়ে যাবে তা কল্পনাও করিনি।আমি এখন সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারছি জান্নাত কতোটা কষ্টে আছে।আমার খুব রাগ হচ্ছিলো।রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে যাচ্ছিলো।
এই রাগটা জান্নাতের উপর নয়,তার পরিবারের উপর হচ্ছে।আমি দুহাত দিয়ে আমার পুরো মুখটা একবার মুছে নিলাম।তারপর উঠে জান্নাতের কাছে গিয়ে তার সামনে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে তার হাত দুটো শক্ত করে ধরি।সে অবাক হয়ে কান্নাসিক্ত নয়নে আমার দিকে তাকায়।আমাদের দুজনের চোখ এখন সম্পূর্ণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।আমি এবার বলতে শুরু করি…..
আমিঃপ্রথমত আমি খুবই দুঃখিত আপনার কাছে।এতোকিছু না জেনেই কতো খারাপ ব্যবহার করেছি আপনার সাথে।আপনার কোথাও যেতে হবে না৷আপনার যতোদিন ইচ্ছা আপনি এখানে থাকুন।আমি মাকে সব বুঝিয়ে বলবো।মা যদি আমার কথা নাও মানে আমি আপনাকে আলাদা একটা ফ্ল্যাট কিনে দিবো।আপনি সেখানে যতোদিন খুশি থাকবেন কিন্তু আপনার কোন ক্ষতি আমি হতে দিবো না প্রমিস করছি।
জান্নাত মুচকি হাসে আর বললো…..
জান্নাতঃপাগল হবেন না রাশেদ সাহেব।আমার জীবনটা তো শেষ,যেদিন আমার আপন মা মারা গিয়েছে।আপনার মাকে আমার কথা বলে অযথা কষ্ট আর ঝামেলা দিতে হবে না।আমি আমার নিয়তি মেনে নিয়েছি।আপনার মা আসার আগেই আমি আবার আমার পরিবারের কাছে ফিরে যাবো।তবে তার আগে জীবনটা শেষবারের মতো করে বাঁচতে চাই।জানি আপনার কাছে কোনো কিছু চাওয়ার আমার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই।তবুও শেষবারের মতো একটা আবদার ভিক্ষা হিসেবে চাইবো।রাখবেন?
আমিঃবলুন।
জান্নাতঃআপনার শহরটা আমাকে একটু ঘুরিয়ে দেখাবেন আপনার বাইকে করে?আমি কখনো কোথাও ঘুরতে যেতে পারিনি।আনন্দ কি জিনিস আমি ভুলেই গিয়েছি।তাই শেষবারের মতো এই আবদারটুকু রাখবেন আমার?আমি আর কিছুই চাইনা এই সাদাকালো জীবনে।
আমিঃআপনি যা বলবেন তাই আমি রাজি।কিন্তু আপনার কি ফিরে না গেলে হয়না?আমিই তো বলছি আপনাকে থাকতে।
জান্নাত হাত দুটো ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেস্ট রুমে যাওয়ার আগে বললো…..
জান্নাতঃআপনি সবকিছু যতটা সহজ ভাবে নিচ্ছেন এই সমাজ কখনো তা নিবেনা।আমি চাইনা আমার জন্য আপনার কোনো সমস্যা হোক।আপনি আমার জীবনের শেষ আবদারটা পূরন করুন আমি তাতেই খুশি।
বলেই জান্নাত তার রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।বুঝলাম আমার সামনে সে আর কাঁদতে চাইছে না।
আমি তার কথাগুলো শুনে কষ্টে নিথর হয়ে মাটিতেই বসে থাকি।তাকে কিছু বলার মতো আমার কাছে আর কিছুই নেই।আমি অনেকটা সময় ওভাবেই বসে থাকি।
চলবে……