অপরিচিতা মেয়ে যখন আদুরে বউ পর্ব_০৮

আমি তার কথাগুলো শুনে কষ্টে নিথর হয়ে মাটিতেই বসে থাকি।তাকে কিছু বলার মতো আমার কাছে আর কিছুই নেই।আমি অনেকটা সময় ওভাবেই বসে থাকি।

জান্নাতের অব্যক্ত অপ্রিয় সত্যগুলো শুনে আমি এখনো স্তব্ধ হয়ে আছি।তবে ও আমার কাছে একটা শেষ আবদার করেছে।আমি চাই ওর আবদারটা পূর্ণতা পাক।তাই নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালাম।অনেক কিছু ভাবতে হবে৷জান্নাত এই ইট পাথরের শহরটা ঘুরে দেখতে চায়,একটু আনন্দ করতে চায়,জীবনটাকে উপভোগ করতে চায়।আর আমি তার এই প্রতিটি চাওয়া পূরণ করতে চাই।আমি সোজা আমার রুমে এসে ফোনটা খুঁজে বসকে একটা কল দিলাম। কিছুক্ষণ রিং হতেই বস কল ধরে।আমি তাকে সালাম দিয়ে বললাম…..

আমিঃসরি স্যার এই বন্ধের দিনে আপনাকে কল দিয়ে ডিস্টার্ব করলাম।

বসঃনা না সমস্যা নেই রাশেদ।তুমি কি জরুরি কিছু বলবে?

আমিঃজি স্যার।আসলে স্যার আমি তো এ পর্যন্ত তেমন কোন ছুটি নেইনি অফিস থেকে।আমাকে কি এক সপ্তাহের জন্য ছুটি দেওয়া যাবে?শুধু এই একটা সপ্তাহ আমাকে ছুটি দিন স্যার।দরকার হলে আমি আর কখনো ছুটি চাইবো না।

বসঃআহহা এভাবে বলছো কেন তুমি!তুমি আমার অফিসের একটা বড় সম্পদ।তোমার মেন্টালি ভালো থাকা আমার জন্য অনেক উপকারী।তোমার যে কয়দিন লাগে তুমি ছুটিতে থাকো। কোনো সমস্যা নেই।

আমিঃসত্যি বলছেন স্যার?(অবাক হয়ে)

বসঃহ্যাঁ।

আমিঃঅসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।আমি এক সপ্তাহই ছুটি নিবো।আর বাসায় বসে যতোটুকু পারি ততোটুকু কাজ করে দিবো।কোনো কাজ পেইন্ডিং থাকবে না ইনশাআল্লাহ।আমি কথা দিলাম স্যার।

বসঃআচ্ছা আচ্ছা তুমি এতস চিন্তা করো না।তুমি রিলেক্সে ছুটি কাটাও।তা রাশেদ তুমি ছুটি কেন নিতে চাচ্ছো সেটাই তো জানা হলো না।

আমিঃআসলে স্যার পারসোনাল কিছু কাজ এসে পড়েছে যেটা না করলেই নয়৷তাই একটু…..

বসঃওহ!ওকে ওকে।কোনো সমস্যা নেই।তুমি ছুটি শেষ করে মাইন্ড ফ্রেশ করে কাজে এসো।

আমিঃধন্যবাদ স্যার৷ভালো থাকবেন।

এরপর বসকে সালাম দিয়ে ফোন রেখে দিলাম।আসলে বস আমাকে খুব ভালবাসে।বাসবেই বা না কেন,আমার বানানো অনেক সফটওয়্যার,অ্যাপ্লিকেশন থেকে মাসে মাসে অনেক টাকা মুনাফা করে তার কোম্পানি।আর আমাদের বস মনে করেন,তাদের এমপ্লয়িরা সুস্থ এবং ফ্রেশ মাইন্ডে থাকলে তাদের কাজ থেকে আরও ভালো আউটপুট পাওয়া যাবে।তাই তার কাছে ছুটি চাইতেই তিনি দিয়ে দিয়েছেন৷আমি চাই এই একটা সপ্তাহ সম্পূর্ণ জান্নাতকে দিতে৷তার প্রতিটি ইচ্ছা আমি পূরণ করতে চাই।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে আসে।আমি বাইরে গিয়ে কিছু ফাস্টফুড কিনে আনি।এসে দেখি জান্নাত এখনো বের হয়নি৷আমি সুন্দর করে খাবারগুলো সাজিয়ে আস্তে আস্তে জান্নাতের রুমের কাছে গিয়ে দরজায় নক করলাম।দুইবার নক করলাম,কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই।মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম যে আবার খারাপ কিছু করে বসলো নাকি।তাই জান্নাত বলে যেই জোরে ডাক দিতে যাবো তখনই সে বেরিয়ে আসে।বেরিয়েই আমাকে দেখে সে মাথা নিচু করে ফেলে আর বলে…..

জান্নাতঃকিছু বলবেন?

আমি লাইটের আলোতে যতসটুকু দেখলাম তাতে বুঝলাম সে অনেক কেঁদেছে এতোক্ষন।আমার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠে তার এই অবস্থা দেখে। কিন্তু এখন এসবের সময় নেই।আমি জান্নাতকে অনেক খুশি করতে চাই।তার ইচ্ছাগুলো সব পূরণ করতে চাই৷আমি খপ করেই তার হাত দুটো ধরলাম।সে বেশ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো।মনে হলে একটু ভয়ও পেয়েছে।আমি বেশ কষ্ট করে মুখে হাসি এনে বললাম…..

আমিঃএভাবে রুমের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে রাখলে আপনার আবদারটা কিভাবে পূরণ হবে হ্যাঁ?

জান্নাত চুপ করে আছে মাথা নিচু করে।আমি তার হাত দুটো ছেড়ে তার গালে হাত দিলাম।সে রীতিমতো কেঁপে উঠে।আমি তাকে অন্যকোনো রিয়েকশন না দিতে দিয়ে তার চোখগুলো একসাথে মুছে দিতে দিতে বললাম…..

আমিঃএইযে আপনার চোখগুলো যেভাবে মুছে দিচ্ছি,ঠিক তেমনি আপনার সব কষ্টগুলোও মুছে দিব আমি।শুধু আমার উপর একটু বিশ্বাস রাখুন।

আমার কথাগুলো শুনে জান্নাতের অবাক নয়নগুলো আস্তে আস্তে মলিন হতে থাকে।তার গালগুলো এখনো আমার আয়েত্তে।বেশ নরম তুলার মতো তার গালগুলো।মেয়েদের গাল যে এতো নরম হয় জানা ছিলো না।

জান্নাতকে এই নিয়ে তৃতীয় বারের মতো স্পর্শ করছি।প্রথম স্পর্শটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো।দ্বিতীয় স্পর্শটা তাকে সামলানোর জন্য ছিলো।আর এখনের তৃতীয় স্পর্শটায় আছে তাকে বাঁচতে দেওয়ার বিশ্বাস।আমি জান্নাতের চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।কি সুন্দর একটা নিষ্পাপ মেয়ে।কেউ বাহির থেকে দেখলে কখনোই বুঝবেনা মেয়েটা ভিতর থেকে একদম শেষ।সত্যি বলতে আমিও বুঝিনি।

জান্নাতের যতোবার কাছে এসেছিলাম তখন তাকে অন্য নজরে দেখেছি।সে তখন আমার কাছে অন্যের প্রেমিকা ছিলো।কিন্তু আজ এখন জান্নাত শুধু একটা নিষ্পাপ মেয়ে আমার কাছে।যাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।কাউকে পছন্দ হওয়ার জন্য একযুগ সময়ের প্রয়োজন হয়না,এক মুহূর্তই যথেষ্ট।

জান্নাতের এই করুণ জীবনের গল্প আমার মনে ওর জন্য ভালো লাগা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।জানিনা কতোদিন কতোটা প্রহর আমি তাকে আমার কাছে পাবো।কিন্তু সে যতোক্ষন আমার কাছে আছে আমি তাকে আমার মতো করে বাঁচা শিখাবো।

আমি জানিনা কেন জান্নাতের কাছে আসলে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি তার মাঝে।আমার মন চায় সারাটা জীবন আমরা এভাবে একসাথে থাকি।কিন্তু তা কি সম্ভব?জানিনা৷এখন তা জানতেও চাচ্ছিনা৷এখন শুধু একটা বিষয়ই জানি,আর তা হলো জান্নাতের আবদার পূরণ। আমি যখন জান্নাতের চোখের মাঝে হারিয়ে গিয়েছি তখন সে তা বুঝতে পেরে আমাকে ডাক দেয়…..

জান্নাতঃরাশেদ সাহেব…আমাকে কি এভাবেই ধরে রাখবেন?

আমিঃএহহহ…ওহহহ না না সরি সরি।

আমি জান্নাতকে ছেড়ে দিলাম।আর সাথে ভীষণ লজ্জাও পেলাম।জান্নাত আমার অবস্থা দেখে মুচকি হেসে দিলো।আমি তার হাসি দেখে খুশি হলাম।তারপর লজ্জা ভুলে তাকে বললাম…..

আমিঃআপনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।

জান্নাত ফাস্টফুড দেখে অনেক বেশি খুশি হয়।তার খুশি দেখে আমিও একটু স্বস্তি পাই।এরপর আমি জান্নাতকে বসিয়ে দিয়ে নিজ হাতে তাকে সবগুলো খাবার বেড়ে দিলাম।সে খুব মজা করে খেতে শুরু করে।সত্যিই তাকে দেখে মনে হলো মেয়েটা কখনোই এসব খাবার খায়নি।তাকে একদম বাচ্চা একটা মেয়ের মতো লাগছে।আমি তার সামনে বসে তার খাওয়া দেখছি।সে শুধু মজা করে খেয়েই যাচ্ছে।খেতে খেতে যেই আমার দিকে তার নজর যায় সে মুহূর্তেই লজ্জা পায়।আর খাওয়া থামিয়ে বলে…..

জান্নাতঃসরি,আমি একা একাই খেয়ে যাচ্ছি।আপনার কথা ভাবিই নি।আপনি খাবেন না?

আমিঃআপনার খাওয়া দেখে মনে যে শান্তি পাচ্ছি তাতে আমার মন আর পেট দুটোই ভরে যাচ্ছে।আপনি আয়েশ করে খান আমি দেখি।

জান্নাতঃআপনিও না।নিন এটা খান…..

জান্নাত আমার দিকে একটা চিকেন ফ্রাই এগিয়ে দিলো।আমি না নিলে সে কষ্ট পাবে।তাই আমি নিয়ে তার সাথে খেলাম।জান্নাতকে এখন অনেক খুশি খুশি লাগছে।তার চেহারায় অন্যরকম একটা উজ্জ্বলতা দেখা যাচ্ছে৷আমি মনে মনে ঠিক করলাম তার এই উজ্জ্বলতা সে যতোদিন আমার কাছে থাকবে আমি ততোদিন ধরে রাখবো।জান্নাত খেতে খেতে বললো…..

জান্নাতঃএই খাবার গুলোর নামই শুনে এসেছিলাম এতোদিন,কিন্তু কখনো খাওয়া হয়নি।আজ প্রথম খেয়ে বুঝলাম খাবার গুলো কত্তো মজার।আপনি সত্যিই খুব খুব ভালো।আমার পেট একদম ভরে গিয়েছে।আমি টানা তিনদিন না খেয়ে থাকতে পারবো আজ যা খেলাম।

আমি জান্নাতের কথা শুনে হেসে দিয়ে বললাম…..

আমিঃহাহা,কি যে বলেন না আপনি।এইটুকু খাবার খেয়ে তিনদিন না খেয়ে থাকবেন!আপনি আসলেই একটা পাগলি।

জান্নাত হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে মলিন মুখে আস্তে করে বললো…..

জান্নাতঃএটা আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না।আমি তিনদিন না চার পাঁচ দিনও একটানা না খেয়ে থাকতাম।কেউ এক গ্লাস পানিও সাধেনি আমাকে।সৎ মা আমাকে সবসময় সবার খাওয়া হলে শেষে যা থাকতো তা দিতো।যদি কখনো খাবার না থাকতো তাহলে দিতোও না।এমন কতোরাত গিয়েছে আমি না খেয়ে ক্ষুধার্ত পেটে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি।বাবা কোনোদিন আমাকে জিজ্ঞেসও করেনি আমি খেয়েছি কিনা।কি আশ্চর্য্য তাই না?আসলে আপন মা যে কি জিনিস সে যখন থাকেনা তখন বুঝা যায়।মা পরিবারের সবাইকে আগলে রাখে।আমার মা আমাকে আগলে রাখতো।ইসস,মা যদি তার সাথে আমাকেও নিয়ে যেতো খুব ভালো হতো তাই না রাশেদ সাহেব?

জান্নাতের কথা শুনে আমার চোখ ভেঙে কান্না আসছিলো।আমি সবকিছু ঝাপসা দেখছিলাম।ছেলে মানুষ,তাই জান্নাতের সামনে কান্না করা যাবে না।

আমি ওকে বললাম,আমি একটু আসছি।বলেই নিজের রুমে চলে আসলাম।কারন আমি জানি আপন মানুষ হারিয়ে গেলে কতোটা কষ্ট ফেইস করতে হয়…..

চলবে……

More From Author

You May Also Like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *