আমি ওকে বললাম,আমি একটু আসছি।বলেই নিজের রুমে চলে আসলাম।কারন আমি জানি আপন মানুষ হারিয়ে গেলে কতোটা কষ্ট ফেইস করতে হয়।
আমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন।আমাকে আর মাকে অসম্ভব ভালবাসতেন।কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস,তাকে ছোটকালেই হারিয়ে ফেলি।তখন বুঝি বাবার ছায়া না থাকলে জীবনটা কতোটা কঠিন হয়ে যায়।তাই জান্নাতের কষ্টগুলো আমি যেনো সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করতে পারি।
যার জন্য আমি এতোটা শক্ত মনের হওয়া স্বত্ত্বেও কান্নাটা চলেই আসে জান্নাতের কথাগুলো শুনে।আমি বারান্দায় নিরবে দাঁড়িয়ে ছিলাম।হঠাৎ পিছন থেকে জান্নাত এসে আমার কাঁধে হাত রাখে আর বললো…..
জান্নাতঃআপনি কি কাঁদছেন?প্লিজ কাঁদবেন না।আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি।প্লিজ…..
আমি কোনোকিছু না ভেবেই জান্নাতের দিকে ঘুরে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি।কারন তার কণ্ঠ শুনে আমার অতীতের সব কষ্টগুলো আরও বেশি করে মনে পড়ছিলো।এদিকে জান্নাত পাথরের মতো হয়ে আছে।সে হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি আমি এমন কিছু করবো।আমি শক্ত করে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে আছি।
মনে হচ্ছিল ঠান্ডা তুলার কোনো একটা কিছুকে জড়িয়ে ধরে আছি।আমার উত্তাল মনটা মুহূর্তেই শান্ত হয়ে যায় যখন আমি তাকে জড়িয়ে ধরি।অনেকটা সময় এভাবে কেটে যায়।আমি আস্তে আস্তে জান্নাতকে ছেড়ে তার সামনে আসি।সে আমার দিকে আর আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি।
আকাশে আজ পূর্নিমার সবচেয়ে সুন্দর চাঁদটা উঠেছে।সেই চাঁদের আলো যেনো সম্পূর্ণ জান্নাতের মুখের উপর পড়েছে।সেই আলোতে আমি তার মায়াবী ভীষণ লজ্জামাখা মুখখানা দেখতে পাচ্ছি।আমরা দুজন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।আমাদের মাঝে সময় যেনো থমকে গিয়েছে।
আমি ধীরে ধীরে জান্নাতের ঘোরে পড়ে যাচ্ছিলাম।চাঁদের আলোতে জান্নাতকে এত্তো বেশি সুন্দরী লাগছিলো আমি বলে বুঝাতে পারবো না।আমি আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।জানিনা কি হতে যাচ্ছে সামনে।আমি জান্নাতের কোমড়ে হাত রাখতেই জান্নাত কেঁপে উঠে।
হঠাৎই দমকা একটা হাওয়ার জন্য জান্নাতের কপালের উপর কিছু চুল এসে পড়ে৷আমি একটা আঙুল দিয়ে সেই দুষ্টু চুলগুলোকে তার কানের পিছনে গুজে দিলাম।জান্নাত লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে।আমি আবার তার দিকে তাকালাম।তার গোলাপি মিষ্টি ঠোঁটগুলো থরথর করে কাঁপছিলো।
আমি যেনো আরও বেশি জান্নাতের নেশায় পড়ে যাচ্ছিলাম।জান্নাতও যেনো আমাকে আলিঙ্গন করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।কিন্তু হঠাৎই মনে হলো,এটা ঠিক না।জান্নাত আমার উপর বিশ্বাস করে এখানে এসেছে।আমি ওর বিশ্বাস ভাঙতে পারিনা।আমি কি করতে যাচ্ছিলাম এটা!না না।এটা কখনোই ঠিক হবে না।
আমরা দুজনই হয়তো ঘোরের মধ্যে আছি।যখন এই ঘোর কাটবে জান্নাত আমাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করবে যদি আমি এখন ওর সাথে কিছু করি।ও আমার কাছে একটা আমানত।আমি তার খেয়ানত করতে পারিনা।যে পুরুষ একটা মেয়েকে অসহায় পেয়ে তার সর্বত্র ভোগ করে নিবে৷নাহ…
আমি আস্তে আস্তে জান্নাতকে ছেড়ে একটু দূরে এসে দাঁড়ালাম।আর চাঁদের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললাম…..
আমিঃদেখুন আজকের চাঁদটা ভীষণ সুন্দর,একদম আপনার মতো।
জান্নাত আমাকে সরে যেতে দেখে চোখ মেলে তাকায়৷সে অনেক বেশি অবাক হয়।জান্নাত ভেবেছিলো আমি তার সাথে কিছু একটা করে ফেলবো।কিন্তু হঠাৎ করে যে থেমে যাবো তা সে ভাবেনি।জান্নাত ইচ্ছা করেই আমাকে থামায়নি।থামালে হয়তো আমি কষ্ট পাবো তাই।সে ভাবছে আমি তাকে থাকার আশ্রয় দিয়েছি আরও কতোকিছু করছি,তাই সে যদি তার শরীর দিয়ে আমাকে খুশি করতে পারে তাহলে সেটাই হোক।কারন সে আজ জীবিত থেকেও মৃত প্রায়।তার জন্য যদি কেউ খুশি হয় হোক।কিন্তু আমি জান্নাতের সব ধারনা নিমিষেই শেষ করে দিলাম।জান্নাত খুব অবাক হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করে…..
জান্নাতঃআপনি আমাকে ছেড়ে দিলেন কেন?আমি তো আপনাকে বাঁধাও দেইনি।তাহলে ছাড়লেন কেন?
আমি জান্নাতের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম…
আমিঃআপনি কি ভেবেছেন,আপনি আমার কাছে খুব সস্তা কেউ জি না।আপনি আমার কাছে অনেক মূল্যবান একজন মানুষ।কিভাবে আমি আপনার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আমার সবকিছু ভোগ করে নিবো!আমি এমন না।জীবনে বহু ধরনের সুযোগ আসবে কিন্তু আমাদের সব সুযোগে সবসময় পা দিতে নেই।আজ আপনাকে আমি আপন করে নিলাম।কাল যদি আপনাকে আর আমার কাছে নাই রাখতে পারি,আপনি তো সারাজীবনের জন্য একটা দাগ নিয়ে বেঁচে থাকবেন।যেটা আমি চাই না।আমি চাইনা আমার কোনো প্রিয় মানুষ এভাবে কষ্ট পাক।আর সত্যি বলতে আপনি এতো মানুষের ভীড়ে আমাকে বিশ্বাস করেছেন।আমি কিভাবে আপনার বিশ্বাস ভাঙ্গি বলুন।আপনার এই মায়াবী দুচোখে আমি আর দশটা পুরুষ মানুষের মতো হতে চাইনা।যারা মেয়েদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের সবকিছু কেড়ে নেয়।আপনি আমার চোখের সামনে হাসিখুশি থাকলেই আমি খুশি।আমার এর থেকে বেশি আর কিছুই চাইনা৷
জান্নাতের গাল বেয়ে বেয়ে অশ্রু পড়ছে।সে কল্পনাও করেনি আমি এতোটা ভালো হবো।আমার কথাগুলো শুনে আমার প্রতি তার অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করছে।সাথে আমার প্রতি তার সম্মানও কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে৷পৃথিবীর প্রতিটি মেয়েই এমন মনমানসিকতার ছেলে চায়।মনের গহীনে জান্নাতও হয়তো এরকম কাউকে চেয়েছিলো।কিন্তু আমিই যে সেরকম কেউ হবো তা সে ভাবেনি।জান্নাত নিঃশব্দে কাঁদছিলো।আমি তা দেখে বিচলিত হয়ে তার একটু কাছে গিয়ে চোখের পানিগুলো মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম….
আমিঃএকি!কাঁদছেন কেন?
জান্নাতঃভেবেছিলাম আমার সবকিছু দিয়ে আপনাকে খুশি করবো।কারন আমার জীবনে আমি অন্যদের জন্য যতো যাই করেছি কেউ খুশি হয়নি শুধু মা বাদে।তাই আজ ভাবলাম আপনি এতোকিছু করলেন আমার জন্য।আমি যদি আমার সবকিছু দিয়ে আপনাকে খুশি করতে পারি তাহলে তাই হোক।কিন্তু আমি কল্পনাও করি আমি নিজেকে কতোটা সস্তা বানিয়ে ফেলছিলাম।তাই নিজের উপর এখন ঘৃণা হচ্ছে।
আমিঃআহহা,আপনি শুধু শুধু এসব ভাবছেন।আপনার কোন দোষ নেই।আপনি মেয়ে মানুষ,মাথায় যেটা এসেছে সেটাই করছিলেন৷কিন্তু আমাদের পুরুষদের দায়িত্ব বেশি।আপনারা ভুল করতে নিলে বা আমরাই ভুল পথে যেতে নিলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।আমি আপনাকে কোনো দোষ দিবো না৷আর লজ্জিত আমি।আমিই অজান্তে আপনার অনেকটা কাছে চলে গিয়েছিলাম।আপনি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন৷নাহলে আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।
জান্নাতঃনা না এ কি বলছেন!আপনি কেন ক্ষমা চাচ্ছেন।আপনার মতো ভালো মানুষ আর একটা আছে কিনা আমার জানা নেই৷আপনার মতো যদি সব পুরুষেরা এমন হতো তাহলে আর কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট হতো না।তারা অনেক ভালো থাকতো।
আমিঃহুম পরিবর্তন হবে।হয়তো আমার মতো আরও এমন অনেক পুরুষ আছে যারা মেয়েদের অনেক সম্মান করে আর তাদের কোনো ক্ষতি হতে দেয় না।
জান্নাতঃহয়তো আছে,হয়তো নেই।তবে আমার চোখে আপনিই সেরা।
আমি জান্নাতের কথা শুনে হাসলাম আর বললাম…..
আমিঃচলুন আজ ঘুমিয়ে পড়ি।কাল সকালে তাড়াতাড়ি উঠে সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরাঘুরি করবো তার একটা প্লান করতে হবে।
জান্নাতঃরাশেদ সাহেব আপনি কি আজও সোফাতে ঘুমাবেন?
আমিঃহ্যাঁ,কেন আপনার সাথে ঘুমাতে বলবেন নাকি?(মজা করে)
জান্নাত লজ্জা পেয়ে বলে…..
জান্নাতঃধুর আপনিও না।আচ্ছা শুনুন না,আমি বলছি কি আপনার যদি কোনো সমস্যা না হয় ডাইনিং রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে রাখলে আমি হয়তো গেস্ট রুমেই ঘুমাতে পারবো।আমি চাইনা এভাবে সোফাতে ঘুমিয়ে আপনি কষ্ট পান।
আমিঃউমম,এক কাজ করুন,আপনি আমার রুমেই ঘুমান,আমি বরং গেস্ট রুমে গিয়ে ঘুমাই।আমার রুমে তো টেবিল ল্যাম্প আছে।সো অন্ধকার হবে না।কিন্তু গেস্ট রুমটা একটু অন্ধকার হয়ে যায়।আপনার হয়তো ভয় লাগতে পারে।
জান্নাতঃআপনি আসলে আপনিই।আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যা বলবেন তাই।
এরপর আমরা দুজন দুইরুমে ঘুমিয়ে পড়ি।একসাথে একই রুমে ঘুমানোটা আপাতত ঠিক না৷সেটা জান্নাতও হয়তো বুঝতে পেরেছে।তাই সে তার ভয়টাকে জয় করে আলাদা ঘুমানোটাকেই বেছে নিয়েছে।
পরদিন সকালে নয়টা নাগাদ আমার ঘুম ভাঙে।তাও মায়ের ফোন দেওয়ার জন্য।মায়ের সাথে কিছুক্ষন কথা বলে উঠে বসলাম।মাকে জানিয়ে দিলাম যে আমি কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়েছি অফিস থেকে যাতে অফিসের কাজগুলো বাসায় বসে ঠান্ডা মাথায় শেষ করতে পারি।যেটা অনেকটাই সত্য।তাই মাকে মিথ্যাও বলা হয়নি আর সত্যটাও সে জানতে পারেনি।আমি আস্তে আস্তে উঠে আগে ফ্রেশ হওয়ার জন্য রুমের বাইরে আসতেই পুরো অবাক।জান্নাত রান্না ঘরে কি যেনো করছে।আমি দ্রুত তার কাছে গিয়ে দেখি সে নাস্তা বানাচ্ছে।চুলাতে আলু ভাজি হচ্ছে আর সে রুটি বানাচ্ছে।রুটিগুলো বেশ সুন্দর গোলাকার হয়েছে।আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম…..
আমিঃআপনি এতো সকালে উঠে নাস্তা বানাচ্ছেন কেন?আমি তো বাইরে গিয়ে আনতামই।
জান্নাতঃবাইরের নাস্তা খেলে আপনার শরীর খারাপ হবে।আপনি তো সবসময় আপনার মায়ের হাতের রান্না খেয়ে বের হন।আজ না হয় আমার হাতের রান্না খেলেন।
আমিঃআপনি না সেদিন বললেন আপনি রান্না পারেন না।
জান্নাতঃসাথে তো এটাও বলেছিলাম যে একে বারে পারিনা তা না।পারি তবে মশলা একটু কম বেশি হয়ে যায় এই আরকি।আল্লাহ ভরসা ঠিক হয়ে যাবে রান্না করতে করতে।
আমি মনে মনে খুশিই হলাম যে জান্নাতের হাতের রান্না খাবো।আমি হেসে বললাম…..
আমিঃআপনি আসলেই একটা পাগলি।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
জান্নাতঃঠিক আছে।
আমি এরপর ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি জান্নাত টেবিলে নাস্তা বেড়ে দিচ্ছে।আমি গিয়ে চেয়ারে বসলাম।জান্নাত আমাকে ভাজি আর রুটি বেড়ে দিলো।তারপর…..
চলবে…..