আধখোলা চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখি ঘড়িতে ৩ঃ৩৫ বাজে।দরজার ওপাড়ে কি জান্নাত নক করছে নাকি অন্য কেউ!অজানা এক ভয় কাজ করছে।আমি আস্তে আস্তে উঠে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম…..
আমিঃকে?
অন্যপাশ থেকে আওয়াজ আসলো….
জান্নাতঃআমি জান্নাত,প্লিজ একটু দরজাটা খুলুন।
আমি ভীতু কণ্ঠে বললাম…..
আমিঃকেন কেন কি হয়েছে?
জান্নাতঃআমার খুব ভয় করছে।সব অন্ধকার,আমি কান্না করে দিবো।
তার কথা শেষ হওয়া মাত্রই আমি দরজার এপাশ থেকে শুনছি সে কান্না করছে।কেন জানি এই মেয়েটাকে কান্না করতে দেখলে বা শুনলে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনা।
আমি আল্লাহর নাম নিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখি জান্নাত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সমানে কান্না করছে।আমি পুরো হতভম্ব হয়ে আছে।সে আমাকে দেখে কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বললো…..
জান্নাতঃএতো বড় বাসায় কেউ একা থাকে কিভাবে!ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।এএএএ….
বলেই আবার কান্না শুরু।আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি।এতোরাতে একটা মেয়েকে আমার রুমে ঢুকতে বলবো?না না এটা কেমন করে হয়।কি করবো আমি?আর এই মেয়েও বা কি চায়?আমি জান্নাতকে এভাবে কাঁদতে দেখে কষ্ট পাচ্ছিলাম।তাই তাকে শান্ত করার জন্য বললাম…..
আমিঃআচ্ছা কান্না থামান।বলেন কি করলে আপনি আর ভয় পাবেন না?আরামে চুপচাপ ঘুমাতে পারবেন?
জান্নাত চুপ হয়ে যায়৷মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।আমি আবার জিজ্ঞেস করলে সে বলে…..
জান্নাতঃআসলে আমি বাসায় মায়ের সাথে সবসময় ঘুমাতাম,কখনো একা ঘুমাইনি।আমার একা ঘুমাতে খুব ভয় করে।রাতে একা ঘুমাতেই পারিনা আমি।
আমি এই মেয়ের কথা শুনে রীতিমতো বিশাল বড় একটা ধাক্কা খেলাম।তারমানে সে কি আমার সাথে ঘুমাতে চায়?হায় হায়!জান্নাত বলে কি!ওর মতলবটা কি?আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে যাই কিছুক্ষনের জন্য।তাও নিজেকে সামলে তাকে জিজ্ঞেস করি…..
আমিঃআচ্ছা আপনি কি আমার সাথে একই বিছানায় ঘুমাতে চাচ্ছেন?(বিষ্মিত কণ্ঠে)
জান্নাত মুহূর্তেই আমার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে না না করে।জান্নাত আমতা আমতা করে বললো…..
জান্নাতঃবিছানায় না আমাকে ফ্লোরে একটা চাঁদর আর বালিশ দিলে আমি ঘুমাতে পারবো।তাহলে আর ভয় পাবো না।
আমি আবার স্তব্ধ হয়ে যাই।মানে সে আমার পাশে না ঘুমালেও আমার রুমে ঘুমাতে চায়।নাহ,এই মেয়ের মাথায় কোনো ফন্দি অবশ্যই আছে।আজ রাতটা আমার না ঘুমিয়েই কাটাতে হবে বুঝছি।কি যে একটা ঝামেলায় পড়লাম।জান্নাত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আমি কি বলবো তা শোনার জন্য।আমি তাকে বললাম…..
আমিঃআমি একটা ছেলে মানুষ।আমার সাথে একই রুমে ঘুমানোটা কি আপনার জন্য ঠিক হবে?কেমন লাগে না বলেন?
জান্নাত কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে…..
জান্নাতঃভূতের চেয়ে আপনি অনেক ভালো আছেন।ওরা আমাকে একা পেলে নির্ঘাত মেরে ফেলবে।আপনি মারবেন না তা আমি বিশ্বাস করি।
জান্নাতের কথা শুনে হাসতে হাসতে আমি বিছানায় গিয়ে বসে পড়ি।এই মেয়ের কথাবার্তা পুরো বাচ্চাদের মতো।কি কিউটই না লাগছে তাকে।তার এই কথা শোনার পর তাকে না করার উপায় নেই।তাই বললাম…..
আমিঃঠিক আছে ঘুমান।
জান্নাত অসম্ভব খুশি হয়।সে দ্রুত গেস্ট রুম থেকে তার যা যা দরকার সেগুলো আনতে চলে যায়।আমি বসে বসে হাসছি।এমন অভিজ্ঞতা জীবনেও হয়নি আমার।তবে এখন ভাবছি অন্যকিছু।জান্নাতকে কি এই ঠান্ডা ফ্লোরে ঘুমাতে দেওয়া ঠিক হবে।তার নিশ্চয়ই ঠান্ডা লাগবে!
আমি আরাম করে ঘুমাবো আর সে মেহমান হয়ে নিচে ঘুমাবে!নাহ ব্যাপারটা খারাপ দেখায়।আমি এসব ভাবতে ভাবতেই জান্নাত চলে আসে।এসেই ফ্লোরে চাঁদর ফেলে কিন্তু আমি তাকে থামিয়ে বললাম…..
আমিঃদাঁড়ান।
জান্নাত আমার দিকে তাকায়।আমি তাকে বলি….
আমিঃআপনাকে ফ্লোরে ঘুমাতে হবে না।
সে অসহায় মুখ করে বলে….
জান্নাতঃতাহলে কোথায় ঘুমাবো?
আমিঃআমার বেডে ঘুমান।
জান্নাত দুই কদম পিছু সরে গিয়ে বলে,
জান্নাতঃকি!!কি বলছেন?আমি আপনার সাথে একই বিছানায় ঘুমাবো!না না অসম্ভব।আমি পারবো না।
আমিঃআরে বাবা কথাটাতো শেষ করতে দিবেন নাকি!আমি বলছি আপনি আমার বেডে ঘুমান আর আমি এই সোফাতে ঘুমাই।
আমার রুমে দুই সিটের ছোট একটা সোফা ছিলো।জান্নাতকে সেটার কথাই বললাম।ও সোফাটা দেখে আমাকে বললো…..
জান্নাতঃনা না প্লিজ,আপনি আমার জন্য কষ্ট করবেন না৷আমি ফ্লোরেই ঘুমাই।সমস্যা হবে না।
আমি রসিকতা করে বললাম…..
আমিঃঘুমান সমস্যা নেই।কিন্তু রাতে যে ফ্লোরে তেলাপোকা আর টিকটিকিরা পার্টি করে তাদের থেকে সাবধানে থাইকেন।
আমার কথা শুনেই জান্নাত রীতিমতো ভয়ে একটা চিৎকার দেয়।আমি হাসতে হাসতে বলি…..
আমিঃকি ঘুমাবেন না?
জান্নাত মাথা নাড়িয়ে না না বলে।আমি আরও মজা পেয়ে হাসতে হাসতে বলি…..
আমিঃতাহলে আজ রাতটা চুপচাপ আমার বেডে ঘুমিয়ে পড়েন।কাল তো বাসায় গিয়ে নিজের বেডেই ঘুমাতে পারবেন।
কথা শেষ করে আমি উঠে একটা মাথার বালিশ আর কাঁথা নিয়ে সোফায় চলে যাই।জান্নাত আস্তে আস্তে আমার বেডের কাছে গিয়ে একপাশে শুয়ে পড়ে।আমিও সোফায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বানরের মতো শুয়ে পড়ি।ইসস!কি শক্ত সোফা।যাইহোক চোখটা বন্ধ করতেই জান্নাত আবার ডাক দেয়।আমি চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে বসে আছে।আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম…..
আমিঃএবার কি হয়েছে?
জান্নাতঃনা না তেমন কিছু না।আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো।
আমিঃহুম বলেন।
জান্নাতঃআমার দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি তার দিকে।আমার রুমে বেডের পাশে সবসময়ই দুইটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলে।আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।আমি সেই ল্যাম্পের আলোতে জান্নাতের চিন্তিত মায়াবী মুখখানা দেখছিলাম।তার মিষ্টি গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁটগুলো কেমন কাঁপছিলো।যেনো কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু বের হচ্ছে না।জান্নাত হঠাৎই বলে…..
জান্নাতঃকাল সকালে বলবো,এখন ঘুমান। আপনাকে অনেক জ্বালাচ্ছি আমি।
বলেই সে ঠাস করে শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে।আমি সোফায় শুয়ে সব দেখছি।তার এরকম কান্ডে আমি আবারও অবাক।কি এমন কথা ছিলো যে সে বলতেই পারলো না!তার ঠোঁটগুলো পর্যন্ত কাঁপছিলো!কি এমন কথা সে বলতে চাচ্ছিলো আমাকে?চিন্তা করতে করতে কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন সকালে…..
ভোরের ঝলমল আলোতে আমার ঘুম ভাঙে।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সকাল ৮ টা ২০ মিনিট বাজে।আজ শুক্রবার।সচারাচর এই দিনে আমি বারোটার আগে ঘুম থেকে উঠিই না….
চলবে…..